বাংলা ভাষার আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিনির্মাণ: প্রভাবক ভূমিকায় কুমিল্লা

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল :  বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখন্ড বিনির্মাণে নেতৃত্বদানকারী মহা নায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা আসলেই অবচেতন মনে সামনে চলে আসে কুমিল্লা এবং কুমিল্লার কিছু ঐতিহাসিক মানুষের কথা। তাই, আজকের এই লিখার প্ররম্ভে সেইসব বিখ্যাত মানুষ এবং তাদের অবদানের সামান্যকিছু আলোকপাত করে, তবেই মূল লিখাতে যেতে চাই। যাঁদের অন্যতম বাংলা ভাষার অবিসংবাদিত নেতা ভাষাসৈনিক বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সন্তান ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, সুরসম্রাটের মেয়ের জামাই পণ্ডিত রবিশঙ্কর, প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত শিল্পী শচীন দেববর্মণ, তাঁর স্ত্রী মীরা দেববর্মণ এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

তাঁদের মধ্যে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও কাজী নজরুল ইসলাম এই দু’জন কুমিল্লার সন্তান না হলেও তাঁরা আমাদের অবিভক্ত কুমিল্লার আত্মার আত্মীয়। তাঁদের দু’জনের কেউই কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ না করলেও বলতে গেলে তাঁদের পূনর্জন্ম হয়েছে এই কুমিল্লা তথা কুমিল্লার মানুষের কল্যাণে। তাই, তাঁরা সরাসরি কুমিল্লার সন্তান না হলেও তাঁদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন জুড়ে রয়েছে কুমিল্লার প্রভাব।

ভাষাসৈনিক বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-এর সাথে আমাদের জাতির জনকের ঘনিষ্ঠতা ছিলো রাজনৈতকি কারণেই। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লা আদালতে উকালতি করতেন এবং আমুত্যু তাঁর কুমিল্লার বাসায় থাকতেন তিঁনি। জাতির জনক রাজনৈকি কারণে কুমিল্লায় এলে বেশিভাগ সময় উঠতেন তৎকালীণ কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগেরর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আহাম্মদ আলী সাহেবের বাসায়। এসময় কুমিল্লার প্রবীন রাজনীতিবীদদের আহাম্মদ আলী সাহেবের বাসায় ডেকে এনে আড্ডা জমাতেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ধীরেন বাবু।

আর কুমিল্লার জামাইবাবু অর্থাৎ আমাদের জাতীয় কবির কাজী নজরুল ইসলামের ভীষণ ভক্ত ছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী কালে যিঁনি (নজরুল) বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরে আন্তরিক ইচ্ছা ও ঐকিান্তি প্রচেষ্টার বদৌলতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবির জন্মদিনে তাঁকে স্থায়ী ভাবে এদেশে নিয়ে আসেন।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জাতীয় কবি স্বীকৃতি লাভেরও পঞ্চাশ বছর আগে কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্য জগতের আতুরঘর কুমিল্লা। বলা যায় এই জনপদের বদৌলতে সংগীত ও সাহিত্য জগতে পূনর্জন্ম লাভ হয় নজরুলের। ১০২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরের আলী আকবর খানের হাত ধরে তরুণ কবি নজরুল প্রথমবারের মতো কুমিল্লা ও দৌলতপুরে আসেন। গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মতে নজরুল যদি সেদিন কুমিল্লায় না আসতেন, তাহলে আজকের সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ যে নজরুলকে আমরা দেখছি, তা না’ও হয়ে উঠতে পারতেন তিঁনি। দৌলপুরের নার্গিসের প্রেম তাঁকে উপহার দিয়েছে প্রেমের কবি। নার্গিসের সাথে বিচ্ছেদ, কুমিল্লায় আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ কবিকে দিয়েছে দ্রোহের চেতনা। শিল্পী সুরসাগর হিমাংশু দত্তসহ এখানকার প্রখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্য তাঁকে প্রেরণা যোগিয়েছে সংগীতে। এখানকার প্রেরণা পরবর্তী সময়ে নজরুকে করে তুলে পরিপূর্ণ এক নজরুল।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম সব সময় স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের। ‘তাঁর (নজরুলের) লিখাতেই সর্বপ্রথম ওঠে এসেছিলো ‘বাংলাদেশ’ নামক শব্দটি’।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে আমাদের যেসব যুক্তি, এর সবই নজরুল ইসলামের মধ্যে ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম ‘বাঙালির বাংলা’প্রবন্ধে লিখেছিলেন, বাঙালি যেদিন এক হয়ে বলতে পারবে বাঙালির বাংলা, সেদিন সে অসাধ্য সাধন করবে। বাঙালি একাই সেদিন ভারত স্বাধীন করবে। এই প্রবন্ধের শেষ দিকে নজরুল লিখেছেন- স্বাধীনতার জন্য, বাঙালিকে তার বীরসত্তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। দুই ধরনের দখলদার আছে—আশপাশের ও বাইরের। তাদের বিতাড়িত করতে হবে। এ জন্য একটা যুদ্ধ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ দরকার।’’

লেখক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন- স্বাধীনতার জন্য মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দাঁড়াতে হবে—এই উপলব্ধি কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম থেকেই ছিল (সূত্র: প্রথম আলো ১৭ মে ২০২৪)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- নজরুলের বলিষ্ঠ লেখনী মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছে ( সূত্র: ঢাকা পোস্ট ২৫ মে ২০২৪)।

অধ্যাপক শ্যামা প্রসাদ ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্রজীবন ব্যাপী সাধনায় যে মানুষটির প্রভাব ইতিহাস স্বীকৃত, সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি আমাদের প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি অগ্নিগিরির প্রচন্ডতায় ঋদ্ধ, অফুরাণ প্রাণ প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা, মহাকাব্যিক ব্যাপকতায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর মতোই বিদ্রোহী কবির জীবন ব্যাপী সাধনা ছিল দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করে স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়ানো।

পরবর্তী সময়ে কবি নজরুলের ’বাংলা’ শব্দটি আমাদের জন্যে স্থায়ী হয় অবিভক্ত কুমিল্লার আরেক কৃতি সন্তান, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র কল্যাণে। কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার রামরাইলে জন্মনেয়া ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন) পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য থাকা কালে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিঁনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। অবশ্যই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তুলেন। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবি নাকচ করে দেন এবং বলেন যে, এর জন্যে তাঁকে (ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে) এর মাশুল দিতে হবে। যার উপর ভিত্তি করেই সূচিত হয়েছিলো ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন গড়ায় ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে।

কবি নজরুলের সুহৃদ কুমিল্লার আরেক বিখ্যাত মানুষ শচীন দেববর্মণ। ভারতীয় সংগীত জগতে যিঁনি এসডি বর্মণ নামেই পরিচিত। কুমিল্লার চর্থায় জন্ম নেয়া ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সন্তান শচীন শৈশবে বাবার হাত ধরেই সংগীত জগতে আসেন। ১৯২১-১৯২৪ সাল নাগাদ কবি কাজী নজরুল যখন কুমিল্লায় আসেন তখন পরিচয় হয় শচীনের সাথে। তরুণ কবি নজরুল কিশোর শচীনের সাথে তাঁর বাড়ীতেই সংগীতের চর্চা করতেন। পরবর্তীকালে শচীন হয়ে ওঠেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত সুরকার ও শিল্পী। খ্যাতির শিখরে উঠা শচীন সস্ত্রীক ভারতের মুম্বাই অবস্থান কালেও কুমিল্লা তথা বাংলাকে ভুলেননি। তাঁদের লিখা ও গানে বরাবরই ওঠে আসে বাংলা ও বাংলাদেশ কথটি। তাঁর (শচীণের) স্ত্রী মীরা দেববর্মণ লিখেলেন- ‘আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল। সব ভুলেযাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের বুল… বাংলা জনম দিলা আমারে….। এই বিখ্যাত গানটিতে নিজের করা সুরে কণ্ঠদেন শচীন নিজেই। যে গান জয় করেছে বাংলা ভাষাভাষীর হৃদয়।

সুরের জগতে আরেক কীংবদন্তী সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। কবি নজরুলের মতো খাঁ সাহেবকেও দেশে এনে মর্যাদা দেয়ার পরিকল্পনা ছিলো জাতির জনকের। কিন্তু ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিঁনি (আলাউদ্দিন খাঁ) পরলোকগমণ করলে জাতির জনকের প্রত্যাশা পূরণ হয়িনি।
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আমাদের অবিভক্ত কুমিল্লার (তৎকালীণ ত্রিপুরা) সন্তান। তিঁনি তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগরের শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিখ্যাত সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’ সাহেবের মেয়ের জামাই। সুর সম্রাটের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীর (বিখ্যাত সুরবাহার শিল্পী) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রবিশঙ্কর। যদিও তিঁনি মেয়ের জামাই ছিলেন, তথাপী খাঁ পরিবারে ছিলেন ছেলে তুল্য। রবিশঙ্করও খাঁ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী মদিনা বিবিকে যথাক্রমে বাবা ও মা বলে ডাকতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব তাঁকে নিজের সন্তান আলী আকবর খাঁ’র মতোই নিজের ঘরে ও নিজের সাথে সাথে রেখে তালিম দিতেন। যার কল্যাণে রবিশঙ্কর নিজেকে বিশ্বখ্যাত সেতার শিল্পীতে পরিণত এবং পণ্ডিত খেতাব লাভ করতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের এই ভূখন্ডের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরেন। মহান স্বাধীনা সংগ্রামের সে সময় পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ’র অবদানের কথা সকলেরই জানা। সে সময় পাকিস্তান সেনারা যখন এদেশের মুক্তিকামী নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা নির্যাতন, নারীদের ধর্ষনসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিলো। সেই বর্বর পাকিস্তানীদের পক্ষেই শক্তি জোগাতে যখন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’র সমরাস্ত্র সুসজ্জিত রণতরী সপ্তম নৌবহর ভুমধ্য সাগরে চলে এসেছিলো। ঠিক সেই সময় আমাদের কুমিল্লার সন্তান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ‘ সাহেবের ছেলে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁদের মার্কিন বন্ধু তৎকালীন সময়ের বিশ্বের সবচাইতে আলোচিত ও তাঁরকা শিল্পী জর্জ হেরিসনকে সাথে নিয় বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে সমর্থন দিয়ে আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান মেডিসন স্কয়ারে আয়োজিত এই কনসার্টের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে রাতারাতি সারাবিশ্বের কাছে ছড়িয়ে পরে। একই সাথে ছড়িয়ে পরে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আসতে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সমর্থন। ওই কনসার্ট থেকে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠানো হয়, বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে।

আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’, শচীন দেববর্মণের ‘বাংলাদেশের ঢোল’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’ কথাটি আজও বাস্তবায়ন হতো কি-না কে জানে। তিঁনি (জাতির জনক) ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একজন ভাবশিষ্য। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখে ছিলেন, “আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকে নারী, সাম্যবাদী সহ কয়েকটি কবিতার কিছু কিছু অংশ শোনালাম।” নজরুল লিখেছেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট…’। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ ভাঙা হতো না। বাঙালী জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করতো না। বাংলাদেশ আজও স্বাধীনতা লাভ করতো না।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের রেশ ধরেই আসে ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে এই ভাষনে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ঝাঁপিয়ে পরেন মুক্তির সংগ্রামে। পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খানের ৪৮ সালের সেই হুমকী বাস্তবায়িত হলো একাত্তরে এসে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ দাবির সেই মাশুল দিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর হতে নিজের জীবন দিয়ে!

শুধু ধীরেন বাবুর আত্মত্যাগ নয়, বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময় আমরা পেলাম মহান স্বাধীনতা। স্বাধীন সার্বভৌম একটি মানচিত্র পেয়েছি, একটি স্বাধীন পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি মায়ের ভাষা।

বাংলা ভাষা বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু এই তিনের সাথে রয়েছে কুমিল্লার এক নিবিড় বন্ধন। তাইতো তিঁনি দেশের পূর্বাঞ্চলে এলেই কুমিল্লায় নামতেন, রাত্রিযাপন করতেন। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী স্থাপনসহ অনেক উন্নয়ণ প্রকল্পে হাত বাড়ান।

জুলা ৫, ২০২৪ তারিখে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর কুমিল্লা সফর’ শীর্ষক বাকীন রাব্বীর লিখেন- ১৯৭২ সালের ৪ জুলাই, সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন কুমিল্লায়। তিনি কুমিল্লাবাসীর উদ্দেশ্যে জনসভায় ভাষণ দেবেন। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বি।.. ..মহান নেতাকে দেখতে, তাঁর কথা শুনতে কুমিল্লার লাখো মানুষ উন্মুখ হয়েছিল।

সকালে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর একটা হেলিকপ্টার যোগে কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্ মাঠে এসে নামলেন। কুমিল্লা পুলিশের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড-অব-অনার দেয়া হয়। তিনি সালাম গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। বিকেলে হাউজিং এস্টেটের জনসমুদ্রে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। (সাংবাদিক হিসেবে ছবি তোলার জন্য আমি, আমার আব্বা ছিলাম। উভয়েই সেই ছবি তুলেছিলাম। কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের সেই ছবিটির একটি ম্যুরাল ২০১৭ সালে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে স্থাপন করা হয়।)

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত (৫ এপ্রিল ২০২১) একটি লিখায় উল্লেখ করা হয়- ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় প্রথম বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা টাউন হল মাঠে ১৯৭০ সালের ২৩ জানুয়ারি (যদিও ১৬ আগস্ট ২০২০ সংখ্যায় সাপ্তাহিক আমোদ-এ প্রকাশিত ‘কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক লিখাতে ওই জনসভার তারিখ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি’র কথা উল্লেখ করেন মোতাহার হোসেনমাহবুব। সেখোনে আরও উল্লেখ- ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ-এ ‘মুজিবের মুক্তিতে জনসভা’শীর্ষক সংবাদ ছাপা হয়।)। এটি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার জনসভা হিসেবে সমাদৃত। সর্বশেষ ১৯৭২ সালের ৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুর একমাত্র জনসভাটি হয় কুমিল্লার হাউজিং এষ্টেট এলাকায় কেটিসিসিএ লিমিটেডের সামনে। এই দুইটি বড় জনসভা আর সেনানিবাসে সামরিক একাডেমির প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে সমাপনী অনুষ্ঠানে ও কুমিল্লার পুলিশ লাইনের প্যারেডে অংশ নেয়া ছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় অগণিত পথসভায় বক্তব্য রাখেন। এ সব পথসভায় অনেকগুলোই জনসভায় রূপ নেয়।’

১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমির প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন। এতে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। ….আমি স্মরণ করি সেই সমস্ত শহীদ ভাইদের- যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, আত্মাহুতি দিয়েছে। আমি স্মরণ করি, বাংলার ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা এনেছে। আজ সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায় এই জন্যেই-বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ।

১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারির পর আর কুমিল্লায় আসা হয়নি বঙ্গবন্ধুর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সুচিত হয় ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ওই দিন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে সপরিবারে প্রাণ দেন আমাদের বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল।
সভাপতি, ঐতিহ্য কুমিল্লা।
জেলা প্রতিনিধি, মাছরাঙা টেলিভিশন।
Imrul60@gmail.com,
(৩০ জুলাই ২০২৪ মঙ্গলবার)

প্রকাশিত : বুধবার, ৩১ জুলাই ২০২৪

স্ক্যাবিস বা চুলকানি থেকে রক্ষা পেতে কী করবেন?

ডায়াবেটিস প্রতিকার ও প্রতিরোধে শক্তিশালী ঔষধ

শ্বেতী রোগের কারণ, লক্ষ্মণ ও চিকিৎসা

শ্বেতীর সাদা দাগ দূর করার উপায়

যৌন রোগের কারণ ও প্রতিকার জেনে নিন

Loading

শেয়ার করুন