শারীরিক সুস্থতায় ইউনানী চিকিৎসার ভূমিকা

হাকীম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান প্রামানিক

সুস্থ থাকার জন্য আমাদের মেডিক্যাল চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এর পাশাপাশি পরীক্ষিত পুষ্টির সমন্বয় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ন্যাচারাল মেডিসিনকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঔষুধ আমাদেরকে সাময়িকভাবে সুস্থতা দান করলেও দীর্ঘমেয়াদী এর নানাবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমতাবস্থায় গতানুগতিক ওষুধের পরিমাণ যথাসম্ভব কমিয়ে ন্যাচারাল মেডিসিন তথা স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া প্রয়োজন। মানুষ অধিক খাবারের ফলে সুস্থ হয় না বা স্বাস্থবান হয় না বরং অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেই খাবারটি যদি স্বাস্থ্যসম্মত না হয় তবে তো এর ভয়াবহতা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে।

ফাস্টফুড তথা জাঙ্ক ফুড পরিহার করে আমরা যদি প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত খাবার তথা মেডিসিন মুক্ত, কেমিক্যালমুক্ত মাছ মুরগি গরু আমরা সবে খেতে পারি কিন্তু যদি কেমিক্যাল যুক্ত খাবার খাওয়া হয় তবে ওই কেমিক্যালের কারণে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয় যা আমাদেরকে আজীবন ভোগায়। এক্ষেত্রে সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সাজানো উচিৎ।

আমাদের চারপাশে জানা -অজানা বিভিন্ন প্রজাতির ঔষুধি গাছ আমাদের চারপাশে রয়েছে। ওষুধি গাছ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে এবং আমাদের অবহেলা,অসচেতনতার কারণে অনেক প্রজাতি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিভিন্ন ঔষুধি গাছ এবং এদের ব্যবহার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ইউনানী ভেষজ বিজ্ঞানে ব্যপক ভাবে বর্ণনা রয়েছে। তাই ভেষজ সংগ্রহ করে যথাসাধ্য পরিচর্যার মাধ্যমে এগুলোকে সংরক্ষণ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

ইউনানি (ইংরেজি: Unani) এক ধরনের ঐতিহ্যগত/প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি যা দক্ষিণ এশিয়ার ও মধ্য এশিয়ার সকল সমাজের মধ্যে অধিক বিস্তার লাভ করেছে। এটা পারসিক-আরবি ঔষধ সৃজনপদ্ধতির একটি ঐতিহ্যকে বোঝানো হয়ে থাকে,যা বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস এবং বিখ্যাত রোমান চিকিৎসক গ্যালেন এর প্রদর্শিত শিক্ষার উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট এবং আরব এবং পারসিক চিকিৎসকবৃন্দ যেমন, আল রাযী, ইবনে সিনা, আল জাহরাবী, এবং ইবনে আন নাফীস দ্বারা বিস্তরভাবে সম্প্রসারিত এবং বিকশিত এক ঐতিহ্যগত চিকিৎসা ব্যবস্থা।

ইউনানী ঔষধ চারটি মানসিক/শারীরিক অবস্থার ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে: শ্লেষা (বলগম), রক্ত (দাম), হলুদ পিত্ত (সাফ্রা) কালো পিত্ত (সাউদা)।

এ চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বাংলাদেশী, ভারতীয় ও চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যগত চিকিৎসার প্রভাবও বিদ্যমান। নাবয্(পালস্ রেট), বওল(মূত্র), বারায(মল) ছাড়াও আরও কয়েকটি লক্ষনের উপর নির্ভর করা হয় সকল ধরনের রোগ নির্ণয়ের জন্য। এ চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগ প্রতিরোধে ছয়টি পূর্বশর্তের (আসবাব-ই-সিত্তা যারুরীয়্যাহ্) উপর নির্ভর করা হয়: বায়ু;খাদ্য এবং পানি;দৈহিক সঞ্চালন ও স্থিতি ; মানসিক সক্রিয়তা ও বিশ্রাম; নিদ্রা ও জাগরণ এবং নিঃসরণ ও অবরোধ ।

বাংলাদেশে প্রায় ২৬৮ টি ইউনানী ঔষধ উৎপাদনকারী কোম্পানি আছে তাদের উৎপাদনকৃত মেডিসিন আমরা ব্যবহার করে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগের বেশি মানুষের ইউনানি, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথির ওপর আস্থা রয়েছে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগ তাঁদের স্বাস্থ্যসেবায় এ সব পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে।

ইউনানী চিকিৎসা এবং ওষুধ বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত৷ বাংলাদেশে এই চিকিৎসা ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে৷ ননকমিউনিকেবল ডিজিজ, যেমন ডয়াবেটিস, প্রেসার, কিডনি রোগ – এগুলোতে ইউনানীতে ভালো চিকিৎসা হয়।

আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে আছে কত রহস্য। প্রাচীনকাল থেকেই ইউনানী ঔষুধি গাছ ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও আধুনিক চিকিৎসায়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানান ধরনের ঔষুধি গাছের সুষ্ঠু প্রয়োগ। শুধু তাই নয় কিডনি,লিভার,হৃদরোগ,ফুসফুসজনিত রোগসহ বর্তমানে প্রায় সব ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে ঔষুধি গাছ থেকে প্রাপ্ত উপাদানসমূহ। নানা প্রকার ঔষধি গাছ যেমন তুলসী পাতা, পুদিনা পাতা এবং মসলা জাতীয় খাবার যেমন দারুচিনি রসুন ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এগুলো নিয়মিত খেলে তা আপনার শরীরের বিভিন্ন হাড় মজবুত করবে। এছাড়াও এদেশে বিভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফলের সমাবেশ ঘটে, যেগুলো দেশীয় ফল নামে পরিচিত। এগুলো কোনোটি মিষ্টি, কোনোটি টক আবার কোনোটি অপূর্ব স্বাদযুক্ত। চির সবুজ দেশ হিসেবে সারাবিশ্ব পরিচিত আমাদের বাংলাদেশ। যেসব প্রাকৃতিক উপাদান এ দেশকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে তার মধ্যে দেশীয় ফল অন্যতম। প্রকৃতির অকৃত্রিম সবুজের সমারোহে অন্যরকম এক সৌন্দর্য যোগ করেছে বাংলাদেশের বিচিত্র সব ফল। ফল সবারই প্রিয় খাদ্য। ফল আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী না হলে অল্প অসুস্থতাতেও মানুষ খুব সহজে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগের আক্রমণও জোরালো হয়। আমাদের চারপা‌শ্বের ঔষধি গাছ, ফল, পাতা,শেকড়, ছাল এগুলো দিয়ে ইউনানী মেডিসিন তৈরী হয় এই মেডিসিন আমাদের শীরের অনেক জটিল রোগ নির্মূল করে।

সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হলে ইউনানী (প্রচলিত ও দেশীয়) চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করতে হবে৷ দরিদ্র মানুষের কাছে ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো জনপ্রিয়৷ কম খরচে চিকিৎসা পায় বলে সাধারণ মানুষ এ সেবা নিতে পছন্দ করে৷ তবে এ চিকিৎসা পদ্ধতির মান বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের আরো তৎপর হতে হবে৷” তাহলে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ভারত, চীন ও জাপানে মতো বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হবে।

হাকীম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান প্রামানিক
প্রভাষক, চাঁদপুর ইউনানী তিব্বীয়া কলেজ ও হাসপাতাল
পুরানবাজার, চাঁদপুর।

Loading

শেয়ার করুন