ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ, প্রতিকার ও করণীয়
ডা. মো. আশরাফুল হক :
ডেঙ্গু এখন আতঙ্কের নাম। কারণ প্রতিদিন শয়ের ওপর রোগী ভর্তি হচ্ছে নানা হাসপাতালে এই রোগের লক্ষণ নিয়ে।
যেকোনো কারণেই হোক, এবার মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সফলতার মুখ দেখেনি। ডেঙ্গু রোগের সাধারণ লক্ষণ যেসব থাকে তা অন্য ভাইরাল রোগের মতোই।
অনেকেই তাই নিজ উদ্যোগে চিকিত্সা নিয়েছেন এত দিন। কিন্তু এবার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ পাল্টেছে। ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু রোগের কিছু খারাপ লক্ষণ প্রকাশ করেছিল, সেগুলো হলো :
—তীব্র পেট ব্যথা।
—মাত্রাতিরিক্ত বমি হওয়া (২৪ ঘণ্টায় তিনবারের বেশি হলে)।
—শরীরে পানি জমে যাওয়া।
—মুখের ভেতরে, চোখের সাদা অংশে রক্তের ছাপ দেখা যাওয়া।
—প্রচণ্ড ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।
—লিভার দুই সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় হয়ে যাওয়া।
—রক্ত পরীক্ষায়
Hct বেড়ে যাওয়া, প্লাটিলেট কমে যাওয়া।
আমাদের শরীরের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, তাতে একবার যদি কোনো ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়, তবে তার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কাজ করার শক্তি অর্জন করে। ডেঙ্গু এত দিন যে ধরনের হতো তার বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে একধরনের জিনিস তৈরি হয়েছে (অ্যান্টিবডি), কোনো কারণে সেই অ্যান্টিবডির সঙ্গে নতুন যোগ হওয়া ডেঙ্গুর ধরনের ক্রস রি-অ্যাকশন হলে তা খারাপ আকার ধারণ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাই কম থাকলে সেটা হয়ে যায় আরো ভয়াবহ।
সাবধানতা : মশা নির্মূল যেহেতু সম্ভব নয়, তাই বেঁচে থাকাটাই এখন কার্যকর ব্যবস্থা। আবার মশা নিয়ে বেশি রক্ষণাত্মক হলে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়।
—মশা দূর করার যেসব ওষুধ আছে তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের কিছুটা উপশম দিতে পারে।
@Mosquito Repellent নামের ওষুধ আছে, যা বাচ্চাদের জামার নির্দিষ্ট অংশে লাগিয়ে রাখা যায়, যাতে তাদের থেকে নিভৃত থাকে।
—দিনের বেলায় ঘুমানোর অভ্যাস ত্যাগ করা।
—মশারি ব্যবহার করা ইত্যাদি।
লক্ষণ : বাচ্চা এবং বয়স্করা সাধারণত শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে থাকে। তাদের অনুভূতি প্রকাশও সাধারণের মতো নয়। তাদের প্রতি আলাদা নজর রাখা দরকার।
—স্বাভাবিক কার্যাবলি কমে গেলে।
—জ্বর চলে যাওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর অস্বাভাবিকভাবে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
—তীব্র ক্ষুধামান্দ্য দেখা যাওয়া।
—শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া।
—প্রস্রাব কমে যাওয়া স্বাভাবিকের চেয়ে।
প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত কাজে ব্যস্ত থাকেন বলে অনেক সময় বুঝতেই পারেন না তিনি কী আসলেই খারাপের দিকে যাচ্ছেন কি না। এমনটির নজির অনেক। মৃত্যুর হার দেখেই বোঝা যায় কতটা উদাসীন হয়ে পড়েছি আমরা। তাই কিছু বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। যেমন—
—জ্বরের সঙ্গে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাচ্ছে কি না।
—শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না।
—যাদের হার্টের সমস্যা ছিল তাদের হূদরোগের কোনো উপসর্গ নতুন করে দেখা যাচ্ছে কি না।
—হূদরোগ ছিল না এমন ব্যক্তির হঠাত্ হূদরোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে এমন হলে।
—স্বাভাবিকের চেয়ে শরীর বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে।
—দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বা প্রেশার কম অনুভব হচ্ছে ইত্যাদি।
করণীয় : প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত ইত্যাদি তরল খাদ্য পান করা উচিত।
—ভিটামিন-সি জাতীয় দেশি ফল বেশি করে খাওয়া উচিত। কারণ এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
—ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত। কারণ এটি রক্তের উপাদানের তারতম্য করাসহ নানাবিধ ক্ষতি করে।
—জ্বর হলে নিজ থেকে চিকিত্সা শুরু করা ঠিক নয়।
—এই মৌসুমে ব্যথার ওষুধ খাওয়ার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন খুবই জরুরি।
কোথায় যাবেন : বিশেষজ্ঞ অথবা এমবিবিএস চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়াটাই নিরাপদ। চিকিত্সক রোগ নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা দেবেন তা প্রতিষ্ঠিত ডায়াগনস্টিক যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক রিপোর্ট করে সেখানে যাওয়া উচিত। কারণ এসব পরীক্ষার ব্যবস্থা এখন অনেক জায়গায় আছে কিন্তু মানহীন কিট, রি-এজেন্ট দ্বারা পরীক্ষা করলে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। রোগ ধরা না পড়লে যেমন ক্ষতি, ভুল রোগ নির্ণয় হলে তার চেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গেলবার চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় নিম্নমানের কিট ব্যবহারের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল জনগণকে। এবারও এমনটা হতে পারে। কারণ কিছু দুষ্কৃতকারী সর্বদা সচেষ্ট মুনাফা লোটার জন্য। ডেঙ্গু নয় কিন্তু রিপোর্ট এলো ডেঙ্গু তাতে আর্থিক, মানুষিক, শারীরিক ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা থাকে। ডেঙ্গু রোগের চিকিত্সায় সরকারি হাসপাতাল সব সময়ই সবচেয়ে ভালো। কারণ যেকোনো সেবা যেকোনো সময় পাওয়ার সুযোগ থাকে। এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়নি।
ডেঙ্গু রোগে রক্তের প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রেও সরকারি কেন্দ্র সেবার দিক দিয়ে এগিয়ে। যিনি রক্ত দেবেন তাঁর কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন—
—রক্ত জমাট না বাঁধার কোনো ওষুধ খেলে তিনি কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা রক্তদান থেকে বিরত থাকবেন।
—একেবারে খালি পেতে রক্তদান কেন্দ্রে যাওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে চার ঘণ্টার বেশি গ্রহণযোগ্য নয়।
—কারো যদি প্লাটিলেট লাগে, তবে তার রক্তদাতাকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ভারী খাদ্য গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে প্লাটিলেটের কাজ কমে যায়।
স্থায়ী সমাধান : সামাজিক বনায়ন খুবই জরুরি, এতে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা হয়, তেমনি এডিস মশার প্রজনন অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
—এমনভাবে বাড়ির ডিজাইন করা উচিত নয়, যাতে পানি যাওয়ার রাস্তা ব্যাহত হয়।
@The intracellular bacterium Wolbachia দিয়ে ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে। আমাদের দেশে এটি করা যায় কি না সে ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করা যায়।
লেখক : ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ