রমজানে রোজা রাখার ফজিলত
ইসলাম ডেস্ক
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু রোজা ছাড়া। কেননা তা আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সে আমার সন্তুষ্টির জন্য কামাচার ও পানাহার পরিত্যাগ করে।
রোজা পালনকারীর জন্য রয়েছে দুটি খুশী যা তাঁকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন রোজার বিনিময়ে আনন্দিত হবে। রোজা পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।’ (বুখারি ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১)
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ، وَالصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ
‘প্রত্যেক আমলেরই কাফফারা আছে। রোজা আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো।’ (বুখারি ৭৫৩৮, মুসনাদে আহমাদ ১০৫৫৪)
হাদিসের বর্ণনায় রোজাকে অন্যান্য আমলের বর্ধিত সওয়াব থেকে আলাদা করা হয়েছে। অন্যান্য আমলের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ করার কথা বলা হলেও রোজার ব্যাপারটি আলাদা। কেননা এর সওয়াব সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহ তাআলা রোজার সওয়াব বহু গুণে দান করবেন। কেননা রোজা সবর তথা ধৈর্য থেকে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ
‘কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে, কোনো হিসাব ছাড়াই।’ (সুরা যুমার: আয়াত ১০)
ধৈর্য তিন ধরনের। এ তিন ধরণের ধৈর্য রোজার মধ্যে একত্রিত হয়। আল্লাহর আনুগত্যের ওপর ধৈর্যধারণ করা, আল্লাহর হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকতে ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর ফয়সালাকৃত কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করা। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ، وَالصَّبْرُ ثَوَابُهُ الْجَنَّةُ
‘রমযান মাস ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত।’ (ইবন খুযাইমা ১৮৮৭)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
َالصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
‘ রোজা ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। কেউ যদি তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজা পালনকারী।’ (বুখারি ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১)
হজরত আবু উবাইদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন-
الصَّوْمُ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا
‘রোজা ঢালস্বরুপ যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভেঙ্গে না ফেলে।’ (নাসাঈ ২২৩৫, মুসনাদে আহমাদ ১৬৯০)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الصَّائِمُ حَتَّى يُفْطِرَ
‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। রোজা পালনকারী যতক্ষণ না ইফতার করে।’ (তিরমিজি ৩৪৯৮)
রোজা পালনকারী যদি রাতে নামাজ আদায় করে এবং দিনের বেলায় রোজা পালনের উদ্দেশ্যে শরীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য পানাহার করে তাহলে তা তার জন্য সাওয়াব হিসেবে ধর্তব্য হবে যেমনিভাবে সে রাতে ও দিনে কাজের জন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে ঘুমালে সেটি তার জন্য ইবাদত হবে।
হজরত আবু আলিয়াহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, রোজা পালনকারী গিবত না করা পর্যন্ত ইবাদতে থাকে, যদিও সে বিছানায় ঘুমায়। অতএব, রোজাদার রাত-দিন সব সময়ই ইবাদতে থাকে এবং রোজা অবস্থায় ও ইফতারির সময় তার দোয়া কবুল করা হয়। সে দিনের বেলায় রোজা পালনকারী ও ধৈর্যশীল এবং রাতের বেলায় আহার গ্রহণকারী ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী। ইমাম তিরমিজি ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেন-
الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ بِمَنْزِلَةِ الصَّائِمِ الصَّابِر
‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী, আহারকারীর মর্যাদা হলো ধৈর্যশীল রোজা পালনকারীর মতো।’ (তিরমিজি ২৪৮৬)
১. যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও কামভাব ত্যাগ করেছে বিনিময়ে জান্নাত পাওয়ার আশায়। এ শ্রেণির লোকেরা আল্লাহর সঙ্গে ব্যবসা করেছে। আর যারা উত্তম কাজ করেন তাদের প্রতিদান আল্লাহ নষ্ট করেন না। যারা আল্লাহর সঙ্গে ব্যবসা করবে তারা বিফল হবে না, বরং তারা বিরাট লাভবান হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءَ اللهِ إِلَّا أَعْطَاكَ اللهُ خَيْرًا مِنْه
‘আল্লাহর তাকওয়ার উদ্দেশ্যে যা কিছুই তুমি পরিহার করো, তিনি তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ ২০৭৩৯)
এসব রোজা পালনকারীকে জান্নাতে তাদের ইচ্ছামত খাদ্য, পানীয় ও নারী দান করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيَٓٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ
‘(তাদেরকে বলা হবে) বিগত দিনসমূহে তোমরা যা আগে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো।’ (সুরা হাক্কাহ: আয়াত ২৪)
হজরত মুজাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, এ আয়াতটি রোজা পালনকারীদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে।
হজরত ইয়াকুব ইবন ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিনে তার অলিদের (বন্ধুদের) বলবেন, হে আমার বন্ধুগণ! আমি যখনই তোমাদের দিকে তাকাতাম তখনই তোমাদের ঠোঁট খাদ্যাভাবে শুষ্ক (কুঁচকানো) দেখতাম, তোমাদের চোখ বিনিদ্র দেখতাম, পেট ক্ষুধায় কাঁপত, আজকের দিনে তোমরা তোমাদের নেয়ামতে থাকো, তোমরা পরস্পরে পেয়ালা ভরা শরাব পান করো, তোমরা তোমাদের জন্য যা আগে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো।
হজরত হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, নারী হুর মধুর নদীতে তার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসা আল্লাহর বন্ধুকে বলবেন, তুমি পান পেয়ালার পানীয় গ্রহণ করো। আল্লাহ তোমার প্রতি কঠিন গরমের দিনে তাকাতেন, তুমি প্রচণ্ড তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও পিপাসিত ছিলে। তখন আল্লাহ তোমাকে নিয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ববোধ করতেন। তিনি বলতেন, হে ফেরেশতাগণ! তোমরা আমার বান্দাকে দেখো, সে তার স্ত্রী, কামভাব, খাদ্য ও পানীয় আমার সন্তুষ্টির জন্য আমার কাছে যা কিছু আছে তার বিনিময়ে ত্যাগ করেছে। তোমরা সাক্ষ্য থাকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তিনি সেদিনই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে তোমার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ فِي الجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ: أَيْنَ الصَّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ
‘জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কেয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাঁদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, রোজা পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তাঁরা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাঁদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।’ (বুখারি ১৮৯৬)
রমজান মাসে রোজা পালনকারীদের জান্নাতে বিয়ে দেওয়া হয়। জান্নাতের হুরদের মহর হলো দীর্ঘ সময় ধরে তাহাজ্জুদের নামাজ। আর এ নামাজ রমজান মাসে অধিক হারে আদায় করা হয়।
২. কিছু রোজা পালনকারী দুনিয়াতে আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকেই রোজা পালন তথা বিরত থাকে। তারা তাদের মস্তিষ্ক ও এর চিন্তাধারাকে হেফাজত করে, পেট ও পেটে যা কিছু ধরে সবকিছু সংরক্ষণ করে, মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী পরীক্ষাকে স্মরণ করে, তারা আখেরাত কামনা করে এবং দুনিয়ার সমস্ত চাকচিক্য বর্জন করে। এ ধরণের লোকদের ঈদুল ফিতর হবে তাদের রবের সাথে সাক্ষাতের দিন। তাঁকে দেখা হবে তাদের আনন্দ-উল্লাস।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
ولَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ
‘রোজা পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।’ (বুখারি ১৯০৪, সহীহ মুসলিম ১১৫১)
হজরত মাকহূল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, জান্নাতিগণ জান্নাতে সুঘ্রাণ পাবে। তখন তারা বলবেন, হে আমাদের রব! জান্নাতে প্রবেশের পর থেকে এত সুন্দর সুঘ্রাণ আর কখনও পাইনি। তখন তাদেরকে বলা হবে- এ হলো রোজা পালনকারীদের মুখের সুঘ্রাণ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে রোজা পালন করার তাওফিক দান করুন। রোজা ফজিলত ও মর্যাদা পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।