সাংবাদিকতা: এক ধন্যবাদবিহীন পেশা

ফয়েজ আহমেদ : সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা, যা সমাজের মূল ধারাকে প্রতিফলিত করে, দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণত তেমন কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় না। বরং অনেক সময় অনেকে সাংবাদিকদের বিরক্তি ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেন, এবং সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের কাজকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এটি পরিষ্কার যে সাংবাদিকতা একটি ধন্যবাদবিহীন পেশা, যেখানে প্রতিকূলতা, চ্যালেঞ্জ এবং অবজ্ঞার সাথে সাংবাদিকদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়।

জনগণের দৃষ্টিকোণ

সাংবাদিকরা সাধারণত জনগণের রক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তারা সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং জনস্বার্থে কল্যাণকর তথ্য প্রচার করেন। কিন্তু বহু সময় জনগণ সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে তাদের সমালোচনা শুরু করে।

বিশেষ করে, যখন সাংবাদিকরা সরকারের ভুল, দুর্নীতি বা জনগণের জন্য ক্ষতিকর কোনো তথ্য প্রকাশ করেন, তখন কিছু লোকজন তা অপছন্দ করে। এই সমালোচনার ফলে সাংবাদিকদের মনে হতাশা তৈরি হয়, কারণ যাদের জন্য তারা কাজ করেন, সেই জনগণই তাদের ন্যায্য সম্মান দেয় না। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সাংবাদিকদের কঠোর সমালোচনা করা হয়, তাদের কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে।

সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ

সরকার এবং প্রশাসনও সাংবাদিকদের প্রতিটি পদক্ষেপে সন্দেহের চোখে দেখে। যখন কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সরকারের ভুল, দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা প্রকাশ করে, তখন তা সাধারণত সরকারি পদাধিকারীদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ফলস্বরূপ, অনেক সময় সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, তাদের কাজের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয় এবং কখনো কখনো তারা হামলার শিকারও হন। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সাংবাদিকদের নির্যাতন এবং হুমকি দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটে। এভাবে, সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাজকে পুরস্কৃত বা সম্মানিত করা হয় না, বরং তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সাংবাদিকদের নীরব দুঃখ

সাংবাদিকরা প্রতিদিন নানা রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। একদিকে যেমন তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেন, অন্যদিকে তাদের কাজের জন্য কখনো কখনো সরকার, প্রশাসন এবং জনগণের কাছ থেকে অযথা সমালোচনা ও তিরস্কার সহ্য করতে হয়। অনেক সময় সাংবাদিকরা তাদের রিপোর্টের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপের শিকার হন। ফলে তারা প্রায়শই অসহায় হয়ে পড়েন, কারণ তাদের কাজের পেছনে কোনো ধন্যবাদ বা প্রশংসা নেই।

বিশেষত, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েন। অনেক সাংবাদিক নিরপেক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন বা পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি

সাংবাদিকদের পরিবার প্রায়শই মনে করে যে, এই পেশার কারণে তারা আর্থিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বেশিরভাগ সাংবাদিকই আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাবে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ-সুবিধা দিতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কাজের চাপ এত বেশি হয় যে, তারা সন্তানদের সময় দিতে পারেন না, পারিবারিক অনুষ্ঠানেও অনুপস্থিত থাকতে হয়।

এছাড়া সাংবাদিকতা পেশা আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় হতাশায় ভোগেন। তারা মনে করেন, পরিবারের কর্তা যদি অন্য কোনো পেশায় থাকতেন, তাহলে হয়তো জীবনযাত্রার মান উন্নত হতো। ফলে সাংবাদিকদের আর্থিক অসচ্ছলতা নিয়ে পরিবারের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ জন্ম নেয়। অনেক সাংবাদিককেই পরিবার থেকে পেশা পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের দৃষ্টিভঙ্গি

সাংবাদিকদের অনেক বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন মনে করেন, এই পেশায় থাকা ব্যক্তিরা ‘দালাল’ বা ‘ধান্দাবাজ’। তারা বিশ্বাস করেন, সাংবাদিকরা নানা সুবিধা আদায়ের জন্য নিরপেক্ষতার বাইরে গিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের হয়ে কাজ করেন। অনেকেই ভাবেন, সাংবাদিক হওয়া মানেই রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া। এর ফলে অনেক আত্মীয়ই সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। আবার কিছু আত্মীয়-স্বজন নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ব্যবহার করতে চান। যখন কোনো সুবিধা আদায় করতে ব্যর্থ হন, তখন তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।

সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা হলো— সাংবাদিক মানেই সুবিধাভোগী, ‘টাউট’ বা ‘বাটপার’। অনেকে মনে করেন, সাংবাদিকদের কাজই হচ্ছে ‘উঠতি’ খবর সংগ্রহ করে মানুষকে বিপদে ফেলা। তাই সাধারণ মানুষ অনেক সময় সাংবাদিকদের ভালো চোখে দেখে না।

বাজারের দোকানদারদের মধ্যেও সাংবাদিকদের প্রতি এক ধরনের ভুল ধারণা কাজ করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো সাংবাদিক বাজারে কিছু কিনতে গেলে দোকানি তাকে অতিরিক্ত দাম বলেন। কারণ তারা মনে করেন, সাংবাদিক মানেই ‘ধান্দাবাজ’, যাদের পকেট টাকা ভর্তি। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সাংবাদিকরা ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করে, তাই সুযোগ পেলেই তাদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া উচিত।

বাস্তবতা ও প্রতিকার

সাংবাদিকতা কোনো লোভ-লালসার পেশা নয়। বরং এটি সমাজের স্বার্থে, মানুষের কল্যাণে কাজ করার একটি দায়িত্বশীল পেশা। তবে কিছু অসৎ ব্যক্তি এই পেশাকে কলুষিত করায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে। এই নেতিবাচক ধারণা দূর করতে সাংবাদিকদের নিজেদের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে যে, সাংবাদিকরা সমাজের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

শহরের অনেক বাড়িওয়ালা সাংবাদিকদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। কারণ সাংবাদিকদের অনেক রাতে বাসায় ফিরতে হয়, আবার অনেকে রাতবিরাতে জরুরি কাজে বের হন। এছাড়া, কিছু মিডিয়া হাউস সাংবাদিকদের বেতন সময়মতো দিতে না পারায় বাড়ির মালিকরা তাদের বাসা ভাড়া দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। সাংবাদিকদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের একমাত্র অনুপ্রেরণা তাদের পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধ। সাংবাদিকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি একটি সংকল্প, যেখানে সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশের জন্য নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নেন।

যদি এই পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটে, তাহলে সাংবাদিকতা পেশা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সরকার, প্রশাসন এবং জনগণের উচিত সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশের কাজে সহায়তা করা এবং তাদের সম্মান করা। সবার সমর্থন ও সহানুভূতির মাধ্যমে সাংবাদিকতা আরও শক্তিশালী, প্রভাবশালী এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে উঠতে পারে।

সর্বোপরি, সাংবাদিকতা একটি ধন্যবাদবিহীন পেশা, তবে এটি সমাজের কল্যাণে এক অপরিহার্য শক্তি হিসেবে কাজ করে।

লেখকঃ গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মী।

প্রকাশ : সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি.

সোরিয়াসিস হলে কী করবেন?

স্ক্যাবিস বা চুলকানি থেকে রক্ষা পেতে কী করবেন?

ডায়াবেটিস প্রতিকার ও প্রতিরোধে শক্তিশালী ঔষধ

শ্বেতী রোগের কারণ, লক্ষ্মণ ও চিকিৎসা

যৌন রোগের কারণ ও প্রতিকার জেনে নিন

চর্মরোগ দাউদ একজিমা বিখাউজের কারণ ও প্রতিকার জেনে নিন

চর্মরোগ দাউদ একজিমা বিখাউজের কারণ ও প্রতিকার জেনে নিন

শেয়ার করুন

Loading

শেয়ার করুন