চাঁদপুর-ঢাকা নৌ রুটে তরুণ তরুণীদের ভুয়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে মিলে লঞ্চের কেবিন

নিজস্ব প্রতিবেদক :
চাঁদপুর-ঢাকা নৌ রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোর কেবিনে তরুণ-তরুণীর অশ্লীলতা যেন নিত্য দিনের ঘটনা। লঞ্চে সিসি ক্যামেরা না থাকা এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি না রেখে তরুণ-তরুণীদের বেশি টাকার বিনিময়ে কেবিন ভাড়া দেওয়ায় যেন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার মূল কারণ।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য সহজ এবং আরামদায়ক উপায় নৌপথ। দেশের বৃহত্তম এই নৌপথের প্রধান বাহন লঞ্চ। ঢাকা থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন রুটে প্রায় আশি থেকে নব্বইটি লঞ্চ যাতায়াত করছে। এর মধ্যে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ভোলা, বরিশাল এবং চাঁদপুর অন্যতম। দেশের বিভিন্ন নৌরুটের বিলাসবহুল এসব লঞ্চে ক্যান্টিন, মেডিকেল সেন্টার, গেমস জোন, ডাবল এবং সিঙ্গেল ডিলাক্স কেবিন ছাড়াও ভিআইপি কেবিন সেবা চালু রয়েছে। রয়েছে নামাজ আদায়ের জন্য পৃথক জায়গাও। এসব রুটে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী চলাচল করলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষের নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও মনিটরিং ব্যবস্থা। ফলে লঞ্চে যাতায়াতের নামে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের নিশ্চিত বাহন হিসেবেই বেছে নিচ্ছেন এক শ্রেণির লোক।

অনুসন্ধান বলছে, এদের বেশির ভাগই ছাত্র-ছাত্রী। কেউ কেউ রয়েছেন মধ্যম বয়সের। লঞ্চের কেবিনগুলোই ব্যবহূত হচ্ছে দেহব্যবসা এবং অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের নিরাপদ স্থান হিসেবে। লঞ্চের ডেকের ভাড়া যাই হোক না কেন অতিরিক্ত টাকা দিয়ে লঞ্চের কেবিনেই চলছে এসব অসামাজিক কার্যকলাপ। এসব কাজে পেশাদার পতিতাদের সাথে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলেই মিলে যায় লঞ্চের এসব কেবিন সেবা। এসব যাত্রায় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমিক অথবা পরকীয়ার ফাঁদ পাতা তরুণরাই হয়ে উঠছেন এক রাতের স্বামী।

লঞ্চের নানা জায়গায় আনসার বাহিনীর সেবা থাকলেও রাতের আধারেই একশ থেকে পাঁচশ টাকায় অপরাধীদেরই ইন্ধন জোগাচ্ছেন বলেই অভিযোগ উঠেছে। দিনের পর দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা এসব অপকর্ম চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ অনেকের।

সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ ঢাকা থেকে চাঁদপুরগামী লঞ্চগুলোই বেশি যাতায়াত করছেন। অপেক্ষাকৃত কম ভাড়া এবং একদিনের মাঝেই আবার ঢাকায় ফেরার নিশ্চয়তা পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা চাঁদপুর নৌরুট।

অবৈধ সম্পর্কের জেরেই বরিশালে খুন হয়েছিল রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা লাবণী। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লঞ্চের কেবিনে ফেলে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছিল কথিত প্রেমিক মনিরুজ্জামান। অভিযোগের ভিত্তিতে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করার পর রাজধানীর মিরপুর থেকে মনিরকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।

পরিসংখ্যান বলছে, শুধু লাবনীই নয়। অবৈধ এসব সম্পর্কের শেষে লাবনীর মতো অনেকেই বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাচ্ছেন। কখনো বা অতিরিক্ত টাকা দিতে অসমর্থ হলেই সাজানো এসব স্বামীদেরও ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হতে হয়।

এ সম্পর্কে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কয়েকজন যাত্রী জানান, ৫০০ টাকার ভাড়া ১৫০০ টাকায় দিয়ে কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এসব শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত লঞ্চের কেবিনে যাতায়াত করছেন। কম সময়ের মধ্যে তথা দিনে দিনে আসা-যাওয়া করার সুবিধা এবং কোনো ঝামেলা না থাকায় ঢাকা-চাঁদপুর রূটের লঞ্চকে তারা নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এরা ঢাকা থেকে এক লঞ্চে চাঁদপুর এসে অপর লঞ্চযোগে আবার দিনে দিনেই চাঁদপুর থেকে ঢাকা চলে যায়। এসব তরুণ-তরুণী লঞ্চের আনসার ও বয়দের ম্যানেজ করে অধিক মূল্যে কেবিন ভাড়া করে পুরো সময়টাই কেবিনে কাটায়।

চাঁদপুর থেকে আসা-যাওয়া- ৩ লঞ্চের গ্রীজার আমির হোসেন, শরীফ, সোনার তরী ৩ এর স্টাফ আশিক জানান স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে দিলে কেবিনে থাকতে পারবেন, ভাড়া পড়বে ২’ হাজার টাকা, তবে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিব আমরা।‘আমাদের কাছে সবাই স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লঞ্চের কেবিন ভাড়া নেন। পরবর্তীতে তারা অসামাজিক কার্যকলাপে মেতে ওঠেন। শুধু উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীই নয়, পরকীয়ার জালে আসক্ত হয়ে মধ্যে বয়সি অনেকেই লঞ্চের কেবিনে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিচ্ছেন। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে লঞ্চগুলোতে কলগার্ল তথা দেহ ব্যবসায়ীদের বিচরণ সমপ্রতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ নৌ-পুলিশ এবং বিআইডব্লিউটিএর যৌথ অভিযানে দীর্ঘদিন এসব বন্ধ থাকলেও আবার সরব হয়ে উঠেছে এমভি রবরব, এমভি সোনার তরী, মিতালীসহ বেশ কয়েকটি লঞ্চ। এসব ঘটনার আড়ালে তাস, জুয়া, চাঁদাবাজি, ব্লাকমেইলিং, ধর্ষণ এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ আবাসিক হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা তল্লাশির কারণে নৌপথকেই বেছে নিয়েছে এই শ্রেণির মানুষ। লঞ্চে ভেরিফিকেশন পদ্ধতি না থাকায় অনায়াসেই রাত্রিযাপন করতে পারায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম এই নৌরুট। নৌপথে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে স্মার্ট মনিটরিং সিস্টেম, কুইক রেসপন্স টিম এবং কেবিন যাত্রীদের ভেরিফিকেশন পদ্ধতির আওতায় আনা জরুরি। যেসব তরুণ-তরুণী কেবিন ভাড়া করতে যায়, তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, স্টিল ছবি যেন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ লিপিবদ্ধ করে রাখে পাশাপাশি লঞ্চের স্টাফদেরও সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবে এ সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় লঞ্চের মালিকদের সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ
প্রশাসনিক নিরাপত্তা জোরদার এবং বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

এ প্রসঙ্গে লঞ্চ মালিক প্রতিনিধি মোহাম্মদ বিপ্লব সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘লঞ্চে খুন, ধর্ষণসহ নানা রকমের অপরাধ হচ্ছে। অনেকেই ভুয়া পরিচয় দিয়ে লঞ্চের কেবিনের সেবা গ্রহণ করছেন। এসব কাজে লঞ্চের কেবিন বয়রা ও টিকেট কাউন্টারের কেরানীরা সাহায্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়াও ঢাকা চাঁদপুর নৌ রুটের বেশ কয়েকটি লঞ্চের কেবিনের মধ্যে খুনের ঘটনাও ঘটেছে এবং ওইসব ঘটনায় নিয়মিত মামলা হয়েছে এবং লঞ্চের স্টাফরা দীর্ঘদিন জেল হাজত খেটেছে এর মধ্যে এমভি আব এ জমজম লঞ্চের হত্যা মামলা এখনো চলমান রয়েছে। তবে এসব বিষয় লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হওয়া এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

চাঁদপুরে নৌ পুলিশের ওসি কামরুজ্জামান বলেন, নৌ-নিরাপত্তা রক্ষার্থে আমাদের টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরাসরি অভিযোগ পেলেও দ্রুত সেবাদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকা-চাঁদপুর যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি করার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে দেখছি। এ ক্ষেত্রে নৌ-পুলিশের পাশাপাশি লঞ্চমালিক, স্টাফ এবং সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।’

Loading

শেয়ার করুন